Siddhi
সিদ্ধি
স্বর্গের অধিকারে মানুষ বাধা পাবে না
এই তার পণ
তাই কঠিন সন্ধানে অমর হবার মন্ত্র সে শিখে নিয়েছে
এখন একলা বনের মধ্যে সেই মন্ত্র সে সাধনা করে
বনের ধারে ছিল এক কাঠকুড়নি মেয়ে
সে মাঝে মাঝে আঁচলে ক'রে
তার জন্যে ফল নিয়ে আসে
আর পাতার পাত্রে আনে ঝরনার জল
ক্রমে তপস্যা এত কঠোর হল যে
ফল সে আর ছোঁয় না
পাখিতে এসে ঠুকরে খেয়ে যায়
আরও কিছু দিন গেল
তখন ঝরনার জল পাতার পাত্রেই শুকিয়ে যায়
মুখে ওঠে না
কাঠকুড়নি মেয়ে বলে, 'এখন আমি করব কী!
আমার সেবা যে বৃথা হতে চলল।'
তার পর থেকে ফুল তুলে সে
তপস্বীর পায়ের কাছে রেখে যায়
তপস্বী জানতেও পারে না
মধ্যাহ্নে রোদ যখন প্রখর হয়
সে আপন আঁচলটি তুলে ধ'রে
ছায়া করে দাঁড়িয়ে থাকে
কিন্তু, তপস্বীর কাছে রোদও যা ছায়াও তা
কৃষ্ণপক্ষের রাতে অন্ধকার যখন ঘন হয়
কাঠকুড়নি সেখানে জেগে বসে থাকে
তাপসের কোনো ভয়ের কারণ নেই
তবু সে পাহারা দেয়
একদিন এমন ছিল
যখন এই কাঠকুড়নির সঙ্গে দেখা হলে
নবীন তপস্বী স্নেহ করে জিজ্ঞাসা করত, 'কেমন আছ।'
কাঠকুড়নি বলত, 'আমার ভালোই কী আর মন্দই কী
কিন্তু, তোমাকে দেখবার লোক কি কেউ নেই
তোমার মা, তোমার বোন?'
সে বলত, 'আছে সবাই, কিন্তু আমাকে দেখে হবে কী
তারা কি আমায় চিরদিন বাঁচিয়ে রাখতে পারবে।'
কাঠকুড়নি বলত, 'প্রাণ থাকে না ব'লেই তো
প্রাণের জন্যে এত দরদ।'
তাপস বলত, 'আমি খুঁজি চিরদিন বাঁচবার পথ মানুষকে আমি অমর করব।'
এই বলে সে কত কী বলে যেত
তার নিজের সঙ্গে নিজের কথা
সে কথার মানে বুঝবে কে
কাঠকুড়নি বুঝত না, কিন্তু আকাশে নবমেঘের ডাকে ময়ূরীর যেমন হয় তেমনি তার মন ব্যাকুল হয়ে উঠত
তার পরে আরও কিছু দিন যায়
তপস্বী মৌন হয়ে এল, মেয়েকে কোনো কথা বলে না
তার পরে আরও কিছু দিন যায়
তপস্বীর চোখ বুজে এল
মেয়েটির দিকে চেয়ে দেখে না
মেয়ের মনে হল
সে আর ওই তাপসের মাঝখানে যেন
তপস্যার লক্ষ যোজন ক্রোশের দূরত্ব
হাজার হাজার বছরেও এতটা বিচ্ছেদ পার হয়ে
একটুখানি কাছে আসবার আশা নেই
তা নাই-বা রইল আশা
তবু ওর কান্না আসে; মনে মনে বলে
দিনে একবার যদি বলেন 'কেমন আছ'
তা হলে সেই কথাটুকুতে দিন কেটে যায়
এক বেলা যদি একটু ফল আর জল গ্রহণ করেন
তা হলে অন্নজল ওর নিজের মুখে রোচে
এ দিকে ইন্দ্রলোকে খবর পৌঁছল
মানুষ মর্ত্যকে লঙ্ঘন করে স্বর্গ পেতে চায়- এত বড়ো স্পর্ধা
ইন্দ্র প্রকাশ্যে রাগ দেখালেন
গোপনে ভয় পেলেন
বললেন, 'দৈত্য স্বর্গ জয় করতে চেয়েছিল বাহুবলে
তার সঙ্গে লড়াই চলেছিল
মানুষ স্বর্গ নিতে চায় দুঃখের বলে
তার কাছে কি হার মানতে হবে।'
মেনকাকে মহেন্দ্র বললেন
'যাও, তপস্যা ভঙ্গ করো গে।'
মেনকা বললেন, 'সুররাজ, স্বর্গের অস্ত্রে মর্তের মানুষকে যদি পরাস্ত করেন
তবে তাতে স্বর্গের পরাভব
মানবের মরণবাণ কি মানবীর হাতে নেই।'
ইন্দ্র বললেন, 'সে কথা সত্য।'
ফাল্গুনমাসে দক্ষিণহাওয়ার দোলা লাগতেই
মর্মরিত মাধবীলতা প্রফুল্ল হয়ে ওঠে
তেমনি ঐ কাঠকুড়নির উপরে
একদিন নন্দনবনের হাওয়া এসে লাগল
আর তার দেহমন একটা কোন্ উৎসুক
মাধুর্যের উন্মেষে উন্মেষে ব্যথিত হয়ে উঠল
তার মনের ভাবনাগুলি
চাকছাড়া মৌমাছির মতো উড়তে লাগল
কোথা তারা মধুগন্ধ পেয়েছে
ঠিক সেই সময়ে সাধনার একটা পালা শেষ হল
এইবার তাকে যেতে হবে নির্জন গিরিগুহায়
তাই সে চোখ মেলল
সামনে দেখে সেই কাঠকুড়নি মেয়েটি
খোঁপায় পরেছে একটি অশোকের মঞ্জরী
আর তার গায়ের কাপড়খানি কুসুম্ভফুলে রঙ করা
যেন তাকে চেনা যায় অথচ চেনা যায় না
যেন সে এমন একটি জানা সুর
যার পদগুলি মনে পড়ছে না
যেন সে এমন একটি ছবি
যা কেবল রেখায় টানা ছিল
চিত্রকর কোন্ খেয়ালে
কখন এক সময়ে তাতে রঙ লাগিয়েছে
তাপস আসন ছেড়ে উঠল
বললে, 'আমি দূর দেশে যাব।'
কাঠকুড়নি জিজ্ঞাসা করলে, 'কেন, প্রভু।'
তপস্বী বললে, 'তপস্যা সম্পূর্ণ করবার জন্যে।'
কাঠকুড়নি হাত জোড় করে বললে
'দর্শনের পুণ্য হতে আমাকে কেন বঞ্চিত করবে।'
তপস্বী আবার আসনে বসল
অনেক ক্ষণ ভাবল
আর কিছু বলল না
তার অনুরোধ যেমনি রাখা হল
অমনি মেয়েটির বুকের এক ধার থেকে আর এক ধারে
বারে বারে যেন বজ্রসূচি বিঁধতে লাগল
সে ভাবলে, 'আমি অতি সামান্য
তবু আমার কথায় কেন বাধা ঘটবে।'
সেই রাতে পাতার বিছানায় একলা জেগে ব'সে
তার নিজেকে নিজের ভয় করতে লাগল
তার পরদিন সকালে সে ফল এনে দাঁড়াল
তাপস হাত পেতে নিলে
পাতার পাত্রে জল এনে দিতেই
তাপস জল পান করলে
সুখে তার মন ভরে উঠল
কিন্তু তার পরেই নদীর ধারে
শিরীষগাছের ছায়ায়
তার চোখের জল আর থামতে চায় না
কী ভাবলে কী জানি
পরদিন সকালে কাঠকুড়নি
তাপসকে প্রণাম করে বললে, 'প্রভু, আশীর্বাদ চাই।'
তপস্বী জিজ্ঞাসা করলে, 'কেন।'
মেয়েটি বললে, 'আমি বহুদূর দেশে যাব।'
তপস্বী বললে, 'যাও, তোমার সাধনা সিদ্ধ হোক।'
একদিন তপস্যা পূর্ণ হল
ইন্দ্র এসে বললেন, 'স্বর্গের অধিকার তুমি লাভ করেছে।'
তপস্বী বললে, 'তা হলে আর স্বর্গে প্রয়োজন নেই।'
ইন্দ্র জিজ্ঞাসা করলেন, 'কী চাও।'
তপস্বী বললে, 'এই বনের কাঠকুড়নিকে।'
স্বর্গের অধিকারে মানুষ বাধা পাবে না
এই তার পণ
তাই কঠিন সন্ধানে অমর হবার মন্ত্র সে শিখে নিয়েছে
এখন একলা বনের মধ্যে সেই মন্ত্র সে সাধনা করে
বনের ধারে ছিল এক কাঠকুড়নি মেয়ে
সে মাঝে মাঝে আঁচলে ক'রে
তার জন্যে ফল নিয়ে আসে
আর পাতার পাত্রে আনে ঝরনার জল
ক্রমে তপস্যা এত কঠোর হল যে
ফল সে আর ছোঁয় না
পাখিতে এসে ঠুকরে খেয়ে যায়
আরও কিছু দিন গেল
তখন ঝরনার জল পাতার পাত্রেই শুকিয়ে যায়
মুখে ওঠে না
কাঠকুড়নি মেয়ে বলে, 'এখন আমি করব কী!
আমার সেবা যে বৃথা হতে চলল।'
তার পর থেকে ফুল তুলে সে
তপস্বীর পায়ের কাছে রেখে যায়
তপস্বী জানতেও পারে না
মধ্যাহ্নে রোদ যখন প্রখর হয়
সে আপন আঁচলটি তুলে ধ'রে
ছায়া করে দাঁড়িয়ে থাকে
কিন্তু, তপস্বীর কাছে রোদও যা ছায়াও তা
কৃষ্ণপক্ষের রাতে অন্ধকার যখন ঘন হয়
কাঠকুড়নি সেখানে জেগে বসে থাকে
তাপসের কোনো ভয়ের কারণ নেই
তবু সে পাহারা দেয়
একদিন এমন ছিল
যখন এই কাঠকুড়নির সঙ্গে দেখা হলে
নবীন তপস্বী স্নেহ করে জিজ্ঞাসা করত, 'কেমন আছ।'
কাঠকুড়নি বলত, 'আমার ভালোই কী আর মন্দই কী
কিন্তু, তোমাকে দেখবার লোক কি কেউ নেই
তোমার মা, তোমার বোন?'
সে বলত, 'আছে সবাই, কিন্তু আমাকে দেখে হবে কী
তারা কি আমায় চিরদিন বাঁচিয়ে রাখতে পারবে।'
কাঠকুড়নি বলত, 'প্রাণ থাকে না ব'লেই তো
প্রাণের জন্যে এত দরদ।'
তাপস বলত, 'আমি খুঁজি চিরদিন বাঁচবার পথ মানুষকে আমি অমর করব।'
এই বলে সে কত কী বলে যেত
তার নিজের সঙ্গে নিজের কথা
সে কথার মানে বুঝবে কে
কাঠকুড়নি বুঝত না, কিন্তু আকাশে নবমেঘের ডাকে ময়ূরীর যেমন হয় তেমনি তার মন ব্যাকুল হয়ে উঠত
তার পরে আরও কিছু দিন যায়
তপস্বী মৌন হয়ে এল, মেয়েকে কোনো কথা বলে না
তার পরে আরও কিছু দিন যায়
তপস্বীর চোখ বুজে এল
মেয়েটির দিকে চেয়ে দেখে না
মেয়ের মনে হল
সে আর ওই তাপসের মাঝখানে যেন
তপস্যার লক্ষ যোজন ক্রোশের দূরত্ব
হাজার হাজার বছরেও এতটা বিচ্ছেদ পার হয়ে
একটুখানি কাছে আসবার আশা নেই
তা নাই-বা রইল আশা
তবু ওর কান্না আসে; মনে মনে বলে
দিনে একবার যদি বলেন 'কেমন আছ'
তা হলে সেই কথাটুকুতে দিন কেটে যায়
এক বেলা যদি একটু ফল আর জল গ্রহণ করেন
তা হলে অন্নজল ওর নিজের মুখে রোচে
এ দিকে ইন্দ্রলোকে খবর পৌঁছল
মানুষ মর্ত্যকে লঙ্ঘন করে স্বর্গ পেতে চায়- এত বড়ো স্পর্ধা
ইন্দ্র প্রকাশ্যে রাগ দেখালেন
গোপনে ভয় পেলেন
বললেন, 'দৈত্য স্বর্গ জয় করতে চেয়েছিল বাহুবলে
তার সঙ্গে লড়াই চলেছিল
মানুষ স্বর্গ নিতে চায় দুঃখের বলে
তার কাছে কি হার মানতে হবে।'
মেনকাকে মহেন্দ্র বললেন
'যাও, তপস্যা ভঙ্গ করো গে।'
মেনকা বললেন, 'সুররাজ, স্বর্গের অস্ত্রে মর্তের মানুষকে যদি পরাস্ত করেন
তবে তাতে স্বর্গের পরাভব
মানবের মরণবাণ কি মানবীর হাতে নেই।'
ইন্দ্র বললেন, 'সে কথা সত্য।'
ফাল্গুনমাসে দক্ষিণহাওয়ার দোলা লাগতেই
মর্মরিত মাধবীলতা প্রফুল্ল হয়ে ওঠে
তেমনি ঐ কাঠকুড়নির উপরে
একদিন নন্দনবনের হাওয়া এসে লাগল
আর তার দেহমন একটা কোন্ উৎসুক
মাধুর্যের উন্মেষে উন্মেষে ব্যথিত হয়ে উঠল
তার মনের ভাবনাগুলি
চাকছাড়া মৌমাছির মতো উড়তে লাগল
কোথা তারা মধুগন্ধ পেয়েছে
ঠিক সেই সময়ে সাধনার একটা পালা শেষ হল
এইবার তাকে যেতে হবে নির্জন গিরিগুহায়
তাই সে চোখ মেলল
সামনে দেখে সেই কাঠকুড়নি মেয়েটি
খোঁপায় পরেছে একটি অশোকের মঞ্জরী
আর তার গায়ের কাপড়খানি কুসুম্ভফুলে রঙ করা
যেন তাকে চেনা যায় অথচ চেনা যায় না
যেন সে এমন একটি জানা সুর
যার পদগুলি মনে পড়ছে না
যেন সে এমন একটি ছবি
যা কেবল রেখায় টানা ছিল
চিত্রকর কোন্ খেয়ালে
কখন এক সময়ে তাতে রঙ লাগিয়েছে
তাপস আসন ছেড়ে উঠল
বললে, 'আমি দূর দেশে যাব।'
কাঠকুড়নি জিজ্ঞাসা করলে, 'কেন, প্রভু।'
তপস্বী বললে, 'তপস্যা সম্পূর্ণ করবার জন্যে।'
কাঠকুড়নি হাত জোড় করে বললে
'দর্শনের পুণ্য হতে আমাকে কেন বঞ্চিত করবে।'
তপস্বী আবার আসনে বসল
অনেক ক্ষণ ভাবল
আর কিছু বলল না
তার অনুরোধ যেমনি রাখা হল
অমনি মেয়েটির বুকের এক ধার থেকে আর এক ধারে
বারে বারে যেন বজ্রসূচি বিঁধতে লাগল
সে ভাবলে, 'আমি অতি সামান্য
তবু আমার কথায় কেন বাধা ঘটবে।'
সেই রাতে পাতার বিছানায় একলা জেগে ব'সে
তার নিজেকে নিজের ভয় করতে লাগল
তার পরদিন সকালে সে ফল এনে দাঁড়াল
তাপস হাত পেতে নিলে
পাতার পাত্রে জল এনে দিতেই
তাপস জল পান করলে
সুখে তার মন ভরে উঠল
কিন্তু তার পরেই নদীর ধারে
শিরীষগাছের ছায়ায়
তার চোখের জল আর থামতে চায় না
কী ভাবলে কী জানি
পরদিন সকালে কাঠকুড়নি
তাপসকে প্রণাম করে বললে, 'প্রভু, আশীর্বাদ চাই।'
তপস্বী জিজ্ঞাসা করলে, 'কেন।'
মেয়েটি বললে, 'আমি বহুদূর দেশে যাব।'
তপস্বী বললে, 'যাও, তোমার সাধনা সিদ্ধ হোক।'
একদিন তপস্যা পূর্ণ হল
ইন্দ্র এসে বললেন, 'স্বর্গের অধিকার তুমি লাভ করেছে।'
তপস্বী বললে, 'তা হলে আর স্বর্গে প্রয়োজন নেই।'
ইন্দ্র জিজ্ঞাসা করলেন, 'কী চাও।'
তপস্বী বললে, 'এই বনের কাঠকুড়নিকে।'
Credits
Writer(s): Rabindranath Tagore
Lyrics powered by www.musixmatch.com
Link
Other Album Tracks
Altri album
- Letter To Rathindranath Tagore
- Letter To Lady Ranu Mukhopdhyay (Adhikari)
- Kabuliwala
- Phera Hobe Na
- Basanta Noy Abohela
- Rabindranath Tagore's Gitanjali, Vol. 2
- Rabindranath Tagore's Gitanjali, Vol. 4
- Rabindranath Tagore's Gitanjali, Vol. 5
- Rabindranath Tagore's Gitanjali, Vol. 3
- Rabindranath Tagore's Gitanjali, Vol. 1
© 2024 All rights reserved. Rockol.com S.r.l. Website image policy
Rockol
- Rockol only uses images and photos made available for promotional purposes (“for press use”) by record companies, artist managements and p.r. agencies.
- Said images are used to exert a right to report and a finality of the criticism, in a degraded mode compliant to copyright laws, and exclusively inclosed in our own informative content.
- Only non-exclusive images addressed to newspaper use and, in general, copyright-free are accepted.
- Live photos are published when licensed by photographers whose copyright is quoted.
- Rockol is available to pay the right holder a fair fee should a published image’s author be unknown at the time of publishing.
Feedback
Please immediately report the presence of images possibly not compliant with the above cases so as to quickly verify an improper use: where confirmed, we would immediately proceed to their removal.